সুন্দরবনে মৌমাছির চাক তৈরির অনুকূল পরিবেশ থাকায় মধু উৎপাদন বেড়েছে বলে জানিয়েছে বন বিভাগ।
বিগত যেকোনো বছরের তুলনায় এ বছর সুন্দরবনে মৌচাকের আকার বড় ও পরিমাণ বেশি হওয়ায় চাকে মধুর পরিমাণ বেশি ছিল বলে জানিয়েছে মৌয়ালরা।
জানা গেছে, প্রতি বছর ১ এপ্রিল থেকে সুন্দরবনে মধু আহরণ শুরু হয়ে ৩০ জুন পর্যন্ত টানা তিন মাস মধু আহরণ চলে। বন বিভাগ থেকে অনুমতি নিয়ে সুন্দরবনে মধু আহরণ করতে যায় মৌয়ালরা। তারা বনের মধ্যে ঘুরে ঘুরে মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহ করে। বন বিভাগের নির্ধারিত রাজস্ব জমা দিয়ে এ মধু নিয়ে লোকালয়ে ফিরে আসে মৌয়ালরা। এরপর ওই মধু নানা হাত ঘুরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পৌঁছে যায়।
সুন্দরবনের মধু অনেক সুস্বাদু হওয়ায় দেশের মানুষের কাছে এর ব্যাপক চাহিদা থাকলেও বন থেকে মধু লোকালয়ে আসার পর হাত বদলের সাথে সাথে তার গুনাগত মান নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দেয়।
সুন্দরবন সংলগ্ন বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার মৌয়ালরা বংশপরম্পরায় যুগ যুগ ধরে সুন্দরবন থেকে মধু আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মধু আহরণ করলেও দাদন ব্যবসায়ীদের কারণে মৌয়ালরা প্রকৃত দাম পাচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের তথ্য মতে, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের আওতাধীন এলাকা থেকে ১২২০ দশমিক ৫০ কুইন্টাল মধু এবং ৩৬৬ দশমিক ১৫ কুইন্টাল মোম আহরণ করা হয়। এর মধ্যে মধু থেকে ৯ লাখ ১৫ হাজার ৩৭৫ টাকা এবং মোম থেকে তিন লাখ ৬৬ হাজার ১৫০ টাকা রাজস্ব আয় হয়েছে। সব মিলে মধু ও মোম থেকে বন বিভাগের ১২ লাখ ৮১ হাজার ৫২৫ টাকা রাজস্ব আয় হয়। এর আগের অর্থবছরে সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের আওতাধীন এলাকা থেকে ৭৪২ দশমিক ৫০ কুইন্টাল মধু এবং ২২৯ দশমিক ৫০ কুইন্টাল মোম আহরণ করা হয়। যা থেকে সাত লাখ ৮৬ হাজার ৪৭৫ টাকা রাজস্ব আয় হয়।
বাগেরহাট জেলার শরণখোলা উপজেলার সুন্দরবন সংলগ্ন চালতেবুনিয়া গ্রামের ষাটোর্ধ্ব মোয়াল ইসমাইল হোসেন জানান, দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে সুন্দরবন থেকে তিনি মধু আহরণ করে আসছেন। এ বছরের মৌসুমে একটি নৌকায় করে ১১ জন মধু আহরণ করতে সুন্দরবনের গহীনে যান। টানা ১৫ দিন মধু আহরণ শেষে বাড়িতে ফিরে আসেন। এভাবে দুই দফায় সুন্দরবন থেকে তিন মণ মধু আহরণ করেছেন বলে জানান।
প্রতিবেশীর কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা দাদন নিয়ে মধু আহরণ করতে যান এবং ফিরে এসে ৫০০ টাকা কেজি দরে ওই দাদন ব্যবসায়ীর কাছে আহরিত মধু বিক্রি করেছেন তিনি।
সুন্দরবন থেকে এ বছর বেশি পরিমাণ মধু আহরণ করতে পেরে নিজের খুশির কথা জানিয়ে মৌয়াল ইসমাইল হোসেন আরও জানান, সুন্দরবনে এবারের মতো এত বড় সাইজের ও বেশি সংখ্যক মৌচাক আগে দেখেননি। এ বছর বনে মৌচাক যেমন বেশি তেমনি চাকে মধুর পরিমাণও বিগত বছরগুলোর তুলনায় অনেক বেশি ছিল।
সুন্দরবন সংলগ্ন দক্ষিণ সাউথখালী গ্রামের জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, তারা ১২ জনে মিলে সুন্দরবনে মধু আহরণ করতে গিয়েছিলেন। বনের বড় আন্ধারমানিক, ছোট আন্ধারমানিক, মেহেরআলীর চর, টিয়ার চর, দুর্বা ও ছোট আমবাড়িয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে প্রায় ৩০০ মৌচাক থেকে মধু আহরণ করেন তারা। প্রায় ২০ বছর ধরে সুন্দরবন থেকে মধু আহরণ করলেও এ বছরের মতো সুন্দরবনে এত সংখ্যক মৌচাক আগে কখনো দেখেননি বলেও জানান তিনি।
তিনি বলেন, মৌচাকগুলোতেও মধু ভরপুর ছিল। সুন্দরবনে মানুষের যাতায়াত কম থাকায় মৌমাছি নির্বিঘ্নে চাক তৈরি করে ও বিভিন্ন গাছের ফুল থেকে মধু আহরণ করে চাকে সঞ্চয় করে বলে তার ধারণা।
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন জানান, সুন্দরবনে গাছের ঘনত্ব ও মধুর উৎস বেড়েছে। বিভিন্ন প্রজাতির গাছে ফুলের সংখ্যাও বেড়েছে। মৌমাছি চাক তৈরি করার জন্য অনুকূল পরিবেশ পেয়েছে। এ কারণে সুন্দরবনে এ বছর মধু উৎপাদন বেড়েছে।
বিগত বছরের তুলনায় এবার ৪৭৮ কুইন্টাল মধু এবং ১৩৭ কুইন্টাল মোম বেশি উৎপাদন হয়েছে। আগামীতে সুন্দরবনে আরও বেশি মধু উৎপাদন হবে বলে আশাবাদি সরকারের এই বন কর্মকর্তা।
সর্বশেষ ২০১৮ সালের জরিপ অনুসারে সুন্দরবনে প্রতি হেক্টর এলাকায় বিভিন্ন প্রজাতির গাছের সংখ্যা ৩২ হাজার। এর আগে ২০১৫ সালের জরিপে সুন্দরবনে প্রতি হেক্টরে গাছের সংখ্যা ছিল ২৮ হাজার। সুন্দরবনে গাছ, বন্যপ্রাণী এবং জীববৈচিত্র্য বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে জানান ডিএফও মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন।